তুষার আর রাসেল বাল্যবন্ধু। দুজনের বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলার চরখুকশিয়া গ্রামে প্রাইমারি স্কুলে তারা একই সঙ্গে লেখাপড়া করেছে। কয়েক বছর আগে তুষার তার মায়ের সঙ্গে ঢাকার সাভারে যায়। তার মা স্থানীয় একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন। আর তুষার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাতে শুরু করেন।অটোরিকশা চালাতে গিয়ে পরিচয় হয় বকুলের সঙ্গে। বকুলও অটোরিকশা চালায়। তার বাবা-মা দুজনে সাভারের শ্যামপুর বাজার এলাকার গার্মেন্টসে চাকরি করেন। বকুল আর তুষার দুই বছর ধরে অটোরিকশা চালিয়ে আসছিলেন। মাস ছয়েক আগে বগুড়ার ধুনট থেকে ঢাকায় যায় তুষারের বাল্যবন্ধু রাসেল। তুষারের মাধ্যমে বকুলের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।এরপর থেকে বকুল, রাসেল ও তুষার তিনজনই বন্ধু। তাদের বয়স মাত্র ২০ থেকে ২২ বছর। থাকতেন সাভারের শ্যামপুর বাজার এলাকায়। দ্রুত টাকা আয়ের নেশায় ১৫ দিনের ব্যবধানে দুই অটোরিকশাচালককে খুন ও অপর এক চালককে হত্যার চেষ্টা চালান এই তিন বন্ধু। হত্যার দায় স্বীকার করা জবানবন্দিতে উঠে এসেছে তিন বন্ধুর ভয়ংকর খুনি হয়ে ওঠার গল্প। ভারতীয় সিরিয়াল দেখে টাকা আয়ের নেশাই তাদের এমন অপরাধের পথে নামিয়েছে বলে আদালতকে জানিয়েছে তারা।সাভার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) তারিকুল ইসলাম জানান, অল্প সময়ের ব্যবধানে তিন বন্ধু দুই চালককে খুন করে অটোরিকশা ছিনিয়ে নিয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৭ মার্চ কেরানীগঞ্জের হজরতপুরে অটোরিকশাচালক জাকির হোসেনের (৩৬) লাশ উদ্ধার করা হয়। এই খুনের পাঁচ দিন পর ২ এপ্রিল সাভারের ভাকুর্তায় অপর অটোরিকশাচালক মতিউর রহমানের (২৬) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আর মতিউর খুনের নয় দিন পর ঝাউচরে মাইনুল (২৬) নামের আরেক অটোরিকশাচালককে কুপিয়ে জখম করে তার অটোরিকশা নিয়ে যায় এই তিন বন্ধু। এসব ঘটনায় সাভার থানায় দুটি এবং কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। এই তিনটি ঘটনায় বকুল, রাসেল আর তুষার জড়িত।
গত রোববার রাসেল তিনটি ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। এর আগে জবানবন্দি দেন তুষার ও বকুল। তিনজনই এখন কারাগারে।
তদন্ত কর্মকর্তা সাভার থানার এসআই তারিকুল ইসলাম বলেন, রাসেল, তুষার আর বকুল তিনজনই ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ক্রাইম পেট্রল দেখে অটোরিকশা ছিনতাই করার পরিকল্পনা করেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা স্বীকার করেছেন, দ্রুত টাকা-পায়সার মালিক হতে চান তারা। নিজেরা কেন পরের অটোরিকশা ভাড়ায় চালাবেন। নিজেরাই হবেন অটোরিকশার মালিক।
এই চিন্তা থেকেই তারা ২৭ মার্চ প্রথম অটোরিকশাচালক জাকিরকে ধারালো চাকু দিয়ে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনিয়ে নেন। এরপর ২ এপ্রিল অপর অটোরিকশাচালক মতিউরকে খুন করেন। সব কটি ঘটনাই ছিল ক্লুলেস। সর্বশেষ ১১ এপ্রিল সাভারের মাইনুলকে গুরুতর জখম করে অটোরিকশা ছিনিয়ে নেয় এই তিন বন্ধু। এ ঘটনার সূত্র ধরে দুই অটোরিকশাচালক খুনের রহস্য বেরিয়ে আসে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ২৭ মার্চ অটোরিকশাচালক জাকির হোসেন কেরানীগঞ্জের আলীপুর গ্রাম থেকে রাত আটটায় অটোরিকশা নিয়ে গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে পড়েন। রাতে বাসায় না ফেরায় ফজরের আজানের সময় তার ভাই আবদুল কাদির জাকিরের মুঠোফোনে কল দেন। ফোনে রিং বাজলেও কেউ ধরছিল না। তখন আশপাশের এলাকায় খোঁজখবর করতে থাকেন। লোকজনের মাধ্যমে জানতে পারেন, কদমতলীর কলাতিয়া টু সাভারের হেমায়েতপুরগামী সড়কের পাশে একটা লাশ পড়ে আছে। ওই লাশটি ছিল জাকির হোসেনের।
এই মামলায় আদালতে ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দেয় রাসেল। রোববার আদালতকে রাসেল বলেন, তার বন্ধু বকুলকে নিয়ে কেরানীগঞ্জের কদমতলী সেতুর কাছে যান। সেখান থেকে একটা অটোরিকশা ভাড়া করেন। কিছু দূর যাওয়ার পর বকুল তাকে নির্দেশ দেয় ওই রিকশাচালককে আঘাত করতে। তিনি তখন অটোরিকশা চালককে চাকু দিয়ে আঘাত করেন। পরদিন বকুল তাকে ২ হাজার টাকা দেয়।
গত ২ এপ্রিল বিকেলে সাভারের কাঁঠালতলা কবরস্থান রোড এলাকার বাসা থেকে অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়ে যান অটোরিকশাচালক মতিউর রহমান। রাত ১০টার দিকে তাদের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক মানিক এসে নিহত মতিউরের ভাই মিজানুর রহমানকে জানান, মতিউরের লাশ পড়ে আছে ভাকুর্তার পরিত্যক্ত এবিএম কোম্পানির ইটভাটার সামনের সড়কের পাশে। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গিয়ে মিজানুর দেখেন তার ভাই মতিউরের মরদেহ পড়ে আছে। দেহের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের জখম।
এই খুনের মামলায় আসামি রাসেল রোববার আদালতকে বলেন, সাভারের শ্যামপুর বাজারে বন্ধু বকুলের সঙ্গে তার দেখা হয়। সেখান থেকে অটোরিকশায় করে ইটভাটার কাছে আসেন। তখন চালককে আঘাত করেন তিনি (রাসেল)। এরপর চালক পড়ে যান।
আর সর্বশেষ গত ১১ এপ্রিল সাভারের হেমায়েতপুরের পদ্মার মোড় থেকে দুজন অজ্ঞাত যাত্রীকে নিয়ে রওনা হন অটোরিকশাচালক মাইনুল। রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে মাইনুল ঝাউচরের হাবিব কোম্পানির এবিএম ইটখোলায় আসার পর ওই দুই যাত্রী গাড়ি থামাতে বলেন। গাড়ি না থামালে একজন যাত্রী মাইনুলকে টেনেহিঁচড়ে নামান। আরেকজন ধারালো চাকু দিয়ে আঘাত করেন। তখন যাত্রীবেশী ওই দুই ছিনতাইকারী অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যান।
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাভার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সোহেল রানা খন্দকার বলেন, চালক মাইনুলকে আঘাত করে অটোরিকশা ছিনিয়ে নেয়ার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে তিনি যান। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার কয়েক দিন পর জানতে পারেন, মাইনুলকে মেরে যে অটোরিকশা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল, তা রাস্তায় চলছে। ওই অটোরিকশাচালককে আটক করার পর জানতে পারেন, তুষার আর রাসেল ওই অটোরিকশা ছিনিয়ে বিক্রি করে দেন।
সাভার থানার এসআই তারিকুল ইসলাম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তুষার জানান, কেরানীগঞ্জের জাকির এবং সাভারের মতিউর খুনে তারা তিন বন্ধু জড়িত। এরপর সিরাজগঞ্জ থেকে বকুলকে গ্রেফতার করা হয়। আর গত শনিবার বগুড়া থেকে গ্রেফতার করা হয় রাসেলকে। দুজন নিরীহ অটোরিকশাচালককে খুন ও একজন চালককে হত্যার চেষ্টা চালায় ওই তিন বন্ধু। অটোরিকশা বিক্রি করে দিয়ে তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। রাতের অন্ধকারে খুনের ঘটনাগুলো ঘটিয়ে তাদের ধারণা জন্মেছিল, তারা হয়তো ধারণা জন্মেছিল, তারা হয়তো ধরা পড়বেন না। কিন্তু অপরাধ করে কখনো পার পাওয়া যায়না।